প্লাস্টিক দূষণ: সমুদ্রের জন্য অভিশাপ



প্লাস্টিক দূষণ আজ বিশ্বব্যাপী সমুদ্রের সজীব স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। যা ধ্বংস করছে সামুদ্রিক জীবন। সমুদ্রে আর্বজনার ৯০ শতাংশই প্লাস্টিক। আর এটা হচ্ছে মানুষের তরফ থেকে। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারব এই অমরাই প্রতিনিয়ত করে চলেছি আমাদেরই সর্বনাশ।
সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। আকাশ ছোঁয়া প্লাস্টিক উৎপাদন, নিম্নস্তরের পুনর্ব্যবহার এবং দুর্বল বর্জ্য

ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিবছর ৪ থেকে ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক সমুদ্রে প্রবেশ করে। যা এই গ্রহের উপকূলরেখার প্রতিফুট পরিমান জায়গা ঢেকে রাখার জন্য যথেষ্ট। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০ বছরে যা হবে তিনগুন।

এই প্লাস্টিকের বেশিরভাগই একবার ব্যবহৃত। উৎপাদিত প্লাস্টিকের ৪০ শতাংশই পুনর্ব্যবহার হয় না। ভেবে দেখেছেন কি, আপনার চারপাশে এত প্লাস্টিক সামগ্রী এগুলো যাচ্ছে কোথায় আর কখনো শেষ হবে কি! আর্বজনা এবং দূষণের মাত্রা বোঝার জন্য সমুদ্রে যাওয়ার দরকার নেই, আমাদের চারপাশের আর্বজনার শেষ গন্তব্য সমুদ্র। প্লাস্টিক দূষণে এত সমস্যা হওয়ার কারণ এটি ক্ষয় হয় না। প্লাস্টিক প্রায় চিরকালের। পরবর্তিত প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ, কেবল ছোটো ছোটো টুকরো হয়ে ভেঙে যায় যা মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত, যার পরিবেশগত প্রভাব এখনো নির্ধারণ করা হচ্ছে।

সামুদ্রিক ধ্বাংসাবশেষের বেশিরভাগই মাইক্রোপ্লাস্টিক যা একটি পেন্সিল ইরেজারের চেয়েও ছোট। প্লাস্টিকগুলো কখনো কখনো প্রসাধনী বা প্যাকিং উপকরণগুলোতে পাওয়া মাইক্রোবিডগুলোর মতোও ছোট হয়। আর বড় প্লাস্টিকগুলো সময়ের সাথে ছোট ছোট টুকরো হয়ে যায়। প্রতিটি পরতে তারা ভাঙতে থাকে কিন্তু পুরোপুরি নিঃশেষ হয় না। এভাবে ক্রমাগত জমতে থাকে প্লাস্টিক বাড়ায় দূষণ মাত্রা।

প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক কচ্ছপ, তিমি, সামুদ্রিক পাখি, মাছ, প্রবাল প্রাচীরসহ অগণিত অন্যান্য সামুদ্রিক প্রজাতি এবং বাসস্থানকে প্রভাবিত করে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে, পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি সামুদ্রিক কচ্ছপ এবং প্রতিটি সামুদ্রিক পাখি তাদের জীবদ্দশায় প্লাস্টিক খেয়েছে। সামুদ্রিক প্রাণীরা প্রায় প্লাস্টিক এবং অন্যান্য সামুদ্রিক ধ্বংসাবশেষকে ভুল করে খাবার ভেবে খেয়ে ফেলে। যে কারণে ৯০ শতাংশ সামুদ্রিক পাখি এবং ৩০ শতাংশ কচ্ছপের পেটে প্লাস্টিক পাওয়া যায়। লার্ভা মাছ, ঝিনুক এবং অন্যান্য সামুদ্রিক জীবগুলো প্লাস্টিকের কৃত্রিম মাইক্রোফাইবারগুলো খায়। যেহেতু প্রাণীরা প্লাস্টিক হজম করতে পারে না, তাই এটা তাদের পেটে থেকে যায়। যে কারণে তাদের পেট ভরা বলে মনে হয় যতক্ষন না তারা ক্ষুধার্ত হয়। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, উত্তর-পূর্ব ফ্লোরিডা উপকূল রেখায় আটকে থাকা ১০০টিরও বেশি ক্ষতবিক্ষত সামুদ্রিক কচ্ছপের বাচ্চাদের অন্ত্রে শত শত প্লাস্টিকের দানা রয়েছে।

প্লাস্টিক স্পঞ্জের মতো তাদের চারপাশের জল থেকে মারাত্মক রাসায়নিক এবং ধাতব পদার্থকে আকৃষ্ট করে। খাওয়ার মাধ্যমে এই প্লাস্টিক প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে তাদের যকৃত এবং কোষের ক্ষতি করে। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রাণীর প্রজনন পদ্ধতি। ফলে জেলেদের জীবিকা আহরণ পরে সংকটে। মাছ ধরা পরে কম। প্লাস্টিক সেই প্রজাতির প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর যারা তা গ্রহণ করে এবং যে বাস্তুতন্ত্রে তারা বাস করে। মিথষ্কিয়ার মাধ্যমে ধ্বংসের মুখে এগুতে থাকে বাস্তুতন্ত্র। এটা মানুষের জন্যও ক্ষতিকর যখন তা আমাদের খাবারের প্লেটে ফিরে আসে।
অনেক সময় খাওয়া বাদেও প্রাণীরা আটকে যায় প্লাস্টিক আর্বজনার জালে। এটা সাধারণত ঘটে থাকে সামুদ্রিক প্রাণীর ক্ষেত্রে। যাকে বলা হয় ভূতে মাছ ধরেছে।

আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, জেলেদের দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত মাছ ধরার যন্ত্রপাতি উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারের বাইরে সমুদ্রে পড়ে থাকে বা চলে যায় বা তার অসচেতনভাবে ফেলে দেয়। সামুদ্রিক কচ্ছপ, পাখি, ডলফিন, তিমির মতো সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা বাতাসে শ্বাস নেয়, তারা এ জালে আটকে যায় শ্বাস নেওয়ার জন্য নিজেদেরকে আর পৃষ্টদেশে ফিরিয়ে আনতে পারে না। তারা ডুবে যায় এবং প্রাণ হারায়। সিক্স-প্যাক রিং, প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং অন্যান্য ধ্বংসাবশেষও সামুদ্রিক বন্যপ্রাণীকে আটকে রাখে যা প্রাণীর প্রাণনাশের কারণ। সমুদ্রের প্লাস্টিক দূষণ পরিত্যক্ত মাছ ধরার যন্ত্রপাতি থেকেও হয়ে থাকে। সমুদ্র রক্ষায় নিচের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
 আমাদের সচেতনতা, সদ্ব্যবহার এবং সমুদ্রের প্রতি ভালোবাসাই পারে এসব দূষণ থেকে সমুদ্রকে বাঁচাতে।
 একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে দিন।
 প্লাস্টিক উৎপাদন এবং বর্জ্য রোধে কঠোর আইন প্রনয়ন এবং তা সমর্থন করুন।
 আর্বজনা পুঁতে ফেলুন বা এমন কোথাও রাখার ব্যবস্থা করুন যেন ফিরে না আসে।
 মাছ ধরার সময় স্থানীয় মনোফিলামেন্ট লাইনের জিনিসপত্র ব্যবহার করুন। যদি আপনার জাহাজের দড়িদড়া ব্যাবহারের অনুপোযোগী হয়ে ওঠে বা দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে এর প্রয়োজনীয়তা শেষের দিকে চলে আসে, তাহলে এটাকে সমুদ্রে না ফেলে যথাযথ সংরক্ষণ করুন।
 সমুদ্র সৈকত, নদী পরিচ্ছন্নতায় অংশ নিন।
 মাইক্রোবিডযুক্ত পণ্য এড়িয়ে চলুন।
 সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করুন।

আপনার বন্ধুবান্ধবসহ চারপাশের সকলকে প্লাস্টিক দূষণ এবং অন্যান্য ধ্বংসাবশেষের বিপদ সম্পর্কে জানান। আমাদের সকলের সচেতনতা এবং সঠিক ব্যবহারে সমুদ্র এহেন জীবন ধ্বংসকারী দূষণ থেকে মুক্তি পেতে পারে। প্লাস্টিক দূষণ আজ মানবতার শত্রু সৈন্যের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। গ্রাস করছে সুন্দর সৈকত, উপকূলরেখার প্রতিটি ইঞ্চি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্নরকেল এবং ডাইভ সাইটগুলো। সুন্দর, স্বভাবিক, দূষণমুক্ত, সজীব সমুদ্র সামুদ্রিক জীবন দীর্ঘস্থায়ী করতে সক্ষম। যা আমাদের দিতে পারে বাসযোগ্য পৃথিবী। বাসযোগ্য পৃথিবী চাইলে নিশ্চিত করতে হবে স্বাভাবিক সামুদ্রিক জীবন আর তা করতে পদক্ষেপ চাই এখুনি।
লেখক: ডেপুটি এডিটর, দৈনিক সংবাদ প্রবাহ