
প্রতি জোড়া ১৫০ টাকা মূল্যসীমা পর্যন্ত প্লাস্টিক ও রাবারের তৈরি হাওয়াই চপ্পল এবং পাদুকার জন্য উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি পুনর্বহালের জন্য জোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পাদুকা প্রস্তুতকারক সমিতি।
গতকাল (২৫ জানুয়ারি) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাগর-রুনি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির নেতারা জানান, পূর্বের ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা বাতিল করে ১৫% ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পাদুকা শিল্প মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
পাদুকার উপর পূর্বে প্রদত্ত ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বাতিল করে গত ৯ জানুয়ারি জারিকৃত ‘এসআরও নং ১৪-আইন/২০২৫/২৬৮-মূসক’ শীর্ষক প্রজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করে সমিতির উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন বেলাল লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনে বলেন, প্লাস্টিক ও রাবারের তৈরি হাওয়াই চপ্পল এবং পাদুকার উপর ১৫% ভ্যাট আরোপ করার প্রস্তাব অত্যন্ত অযৌক্তিক। এটি কার্যকর হলে এই সাশ্রয়ী পণ্য সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে | বিশেষত শ্রমজীবী, দিনমজুর, কৃষক, রিকশা-ভ্যান চালক এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, ভ্যাট অব্যাহতির ফলে সরাসরি পণ্যের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছিল। এই ধারাবাহিকতায় নিম্ন আয়ের ক্রেতা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে, এতো উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের উদ্ধগতির মধ্যেও প্রতি জোড়া ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) টাকা মূল্যের রাবার ও প্লাস্টিকের চপ্পল সরবরাহ অব্যহত রেখেছে।
এতো কম টাকায় উৎপাদন খরচের সুবিধা সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছেছিল, যার মাধ্যমে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ সাশ্রয়ী দামে প্রয়োজনীয় হাওয়াই চপ্পল ও পাদুকা ক্রয় করতে পেরেছেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এই পণ্যগুলো অত্যাবশ্যকীয়, কারণ এগুলো ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য পাদুকা।
পাদুকা সমিতির উপদেষ্টা সাখাওয়াত আরও উল্লেখ করেন, এই পণ্যের মূল কাঁচামাল হচ্ছে পরিত্যক্ত রাবার ও প্লাস্টিকের
অপচনশীণ দাদি, যা সংগ্রহ করা হয় দেশের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা অবস্থায় ছিন্নমূল টোকাই ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠির মাধ্যমে। সংগৃহীত এই সমস্ত অপচনশীল পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ও রাবারের চপ্পল রি-সাইক্লিং করে পুনরায় উৎপাদন করা হয়। যা পরিবেশের ভারসাম্য তথা জমির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং জলবদ্ধতা রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
ভ্যাট অব্যাহতির ফলে তারা রিসাইক্লিং কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করতে পেরেছিল। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ কমেছে, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ হ্রাস পেয়েছে। উক্ত বিবেচনায় ভ্যাট আইনের শুরু হতেই আমাদের উৎপাদিত প্লাস্টিক ও রাবারের পাদুকা ভ্যাট অব্যহতি সুযোগ দিয়ে আসা হয়। এই শিল্প দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় রয়েছে, যা পণ্য উৎপাদনের খরচ কমিয়ে গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য সাশ্রয়ী দামে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু ভ্যাট আরোপ করা হলে পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে এবং বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
মালিক সমিতি মনে করছে, গত দুই বছরের বেশী সময় ধরে দেশে যেখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে সেখানে ভোক্তার কাছ থেকে কোন ভাবেই ১৫% ভ্যাট আদায় করা সম্ভব নয়। চাইলেই পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা যায় না। অথচ বিগত সরকারের আমলে পরিষেবার ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকদের মজুরি। দৈনন্দিন খাদ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির চাপতো আছেই।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতে এই ব্যাবসা (৩০-৪০) % কমে গেছে। এই অবস্থায় ভ্যাট বাড়লে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।
তিনি আরো বলেন, যেদিন থেকে ভ্যাট আইন আরোপ করা হয়েছে সেদিন থেকেই এই পণ্যের ভ্যাট অব্যাহতি ছিলো। এমনকি রি-সাইকেল করা প্লাস্টিক হইতে তৈরিকৃত দানার কোন ভ্যাট নাই।
এই পণ্যের উপর কেন বা কিকারণে ভ্যাট আরোপ হবে, যেহেতু রাবারের ও প্লাষ্টিকের চপ্পল রিসাইক্লিং-এর মাধ্যমে উৎপাদন হয়ে থাকে। এই পাদুকা প্রস্তুত পরিবেশ দূষণ রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে।
ব্যবসায়ীদের মতে নিম্ন আয়ের এই পণ্যের উপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপানো হলে দেশের শ্রমজীবি ও নিম্ন আয়ের বৃহৎ জনগোষ্টে যথাঃ কৃষক-শ্রমিক, দিনমজুর, রিক্সা-ভ্যানওয়ালা, ভিক্ষুকসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে হারে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে তাতে উক্ত পণ্য ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে । আর ভোক্তারা ক্রয়ক্ষমতা হারালে এই পণ্যের অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ভ্যাট আইন ও ভ্যাট আরোপ আমরা সমর্থন করি। কিন্তু তা গরিবদুঃখীদের জন্য কোনোভাবেই না।
ভ্যাট আরোপের নেতিবাচক প্রভাব
১. উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি: ১৫% ভ্যাট আরোপ হলে উৎপাদন খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে, যা বিক্রির ক্ষেত্রে দাম বাড়ানোর চাপ সৃষ্টি করবে।
২. ক্রেতার ক্ষতি: নিম্ন আয়ের মানুষেরা এই পণ্য কিনতে পারবে না।
৩. শিল্প ধ্বংস: অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, যা ব্যাপক বেকারত্বের সৃষ্টি করবে।
৪. পরিবেশের প্রভাব: প্লাস্টিক ও রাবার দিয়ে তৈরি হাওয়াই চপ্পল ও পাদুকা মূলত রিসাইক্লিং পদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদিত পরিবেশবান্ধব পণ্য । এই পণ্য উৎপাদনে প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় পরিত্যক্ত রাবার ও প্লাস্টিক জাতীয় অপচনশীল দ্রব্য , যা স্বাভাবিকভাবে পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
সংগঠনের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, এই পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দুই দিক থেকে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হয়েছে।
প্রথমত, টোকাই এবং অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই পরিত্যক্ত রাবার ও প্লাস্টিক সংগ্রহ করে, যা তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
দ্বিতীয়ত, এই অপচনশীল পণ্যগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য হিসেবে তৈরি হওয়ায় পরিবেশ দূষণ রোধে এটি অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি সরকারের কাছে আগামী ৭ দিনের মধ্যে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। দাবি পূরণ না হলে শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট এবং চূড়ান্তভাবে কারখানা বন্ধের মতো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করবে তারা।
সংগঠনের নেতারা বলেন, “আমরা ভ্যাট আইন মানি, তবে তা অবশ্যই দরিদ্র জনগোষ্ঠির স্বার্থ বিবেচনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে । আমরা সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাই, এই ধরনের সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রত্যাহার করে দেশের পাদুকা শিল্প এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করুন।”
পাদুকা প্রস্তুতকারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস (রানা), সিনিয়র সহ-সভাপতি রেজাউল করিম, সহসভাপতি আশরাফ উদ্দিন, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক শাহজাহান রহমান (সাজু), সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন পাদুকা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।