পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালাচ্ছে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা রিয়াজ হামিদুল্লাহ গংদের পর্দার অন্তরাল থেকে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৬ বছরে সবচেয়ে বেশি প্রতাপশালী ছিলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। এই ব্যাচের প্রধান ব্যক্তি হলেন রিয়াজ হামিদুল্লাহ, যিনি ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশে বাংলাদেশী হাই-কমিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। 

এই ব্যাচের আরও উল্লেখযোগ্য কূটনীতিকরা হলো বর্তমানে কানাডায় নিযুক্ত হাই কমিশনার নাহিদা সোবহান, তার স্বামী কাতারে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম, সদ্য লন্ডনে নিযুক্ত হাই কমিশনার আবিদা ইসলাম, মিসরে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ, গণচীনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নাজমুল  ইসলাম এবং ফ্রান্সে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত খন্দকার তালহা ।

পেশাদার কূটনীতিক রিয়াজ  পূর্বে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত, তার আগে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন।

 রিয়াজ হামিদুল্লাহ এবং তার ব্যাচের উল্লেখিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের সময় অনেক অনৈতিক কাজ করার অভিযোগ পাওয়া  গেছে। গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে ব্যাচটি সবচেয়ে নির্লজ্জভাবে তাবেদারি করেছে এবং সুবিধা নিয়েছে, তারা হলেন রিয়াজ হামিদুল্লাহ ও তার সহযোগীরা। 

 রিয়াজ হামিদুল্লাহ ও তার ব্যাচের সহকর্মীরা দুর্নীতি, ক্ষমতার দাপট এবং দেশি-বিদেশি পদ-পজিশনগুলোতে গত এক দশক থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাধারণ কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন। তবে কর্মকর্তারা ভয়ে নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছেন।

সরকারের পালাবদলের সাথে সাথে অত্যন্ত চতুরতার সাথে রং বদলানোতেও তারা সবার শীর্ষে। রিয়াজ হামিদুল্লাহ লেখাপড়া করেন ভারতে। পরবর্তীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর পোস্টিং হয় নয়াদিল্লিতে। দীর্ঘদিন সেখানে বাংলাদেশ হাইকমিশনে চাকরি করেন। 

তবে রিয়াজ হামিদুল্লাহর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো চতুরতার সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে নিজস্ব গ্রুপ তৈরি করা। প্রতিটি ব্যাচ থেকে কিছু অফিসার নিয়ে তার নিজস্ব গ্রুপ আছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। এমনকি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাইরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তিনি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেন।

গত আগস্টে ছাত্র-জনতা বিপ্লবের শেষ পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সরকারের তাবেদারিতে ব্যস্ত ছিলেন। সরকার পতনের সাথে সাথে রিয়াজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অফিসের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে অত্যন্ত দ্রুত সময়ে সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেন। সুকৌশলে  ধূর্ততার সাথে  বর্তমান সরকারের একান্ত অনুগত হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী রিয়াজ হামিদুল্লাহসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের ব্যাপারে খুব শীঘ্রই তদন্ত করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাধারণ কর্মকর্তারা জোর দাবি জানান। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হকের অন্যতম সহযোগী  ছিলেন রিয়াজ হামিদুল্লাহ। আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হককে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতেন রিয়াজ হামিদুল্লাহ। 

 সিনিয়র অফিসারদের বাদ দিয়ে রিয়াজ হামিদুল্লাহকে প্রথম শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রদূত করার পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব শাহিদুল হক। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হলো, রিয়াজ হামিদুল্লাহ শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রদূত হলেও মাসে কমপক্ষে ২০ দিন সরকারি খরচে ঢাকায় অবস্থান করতেন। এই সময়ে তৎকালীন আইএমও -এর কর্মকর্তা শেখ পরিবারের পেপি সিদ্দিকী ও তার স্বামী ববি সিদ্দিকীর সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক তার নিজের স্বার্থেই রিয়াজ হামিদুল্লাহর হাতে মাল্টিলিটারেল উইং তুলে দেন।

রিয়াজ হামিদুল্লাহ শ্রীলঙ্কাতে রাষ্ট্রদূত হয়েও কোনো কারণ ছাড়া দিনের পর দিন ঢাকা থাকার কারণে সরকারের ও দেশের বিশাল আর্থিক অপচয় হয়েছে। এই বিষয়ে তদন্ত পূর্বক আইনসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে অনেকেই দাবি জানান। একই সাথে, রিয়াজ হামিদুল্লাহ, জিএফএমডি সামিট এবং বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপ ফাইভ স্টার হোটেলে আয়োজনের নামে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

 রিয়াজ শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রদূত থাকাকালে, শেখ সেলিমের মেয়ে এবং মেয়ের জামাই তাদের দুই সন্তান সহ শ্রীলংকায় ঘুরতে যায়। ২১ এপ্রিল, ২০১৯ সালে সন্ত্রাসী বোমা হামলায় শেখ সেলিমের সাড়ে আট বছর বয়সী নাতি জায়ান চৌধুরীর অত্যন্ত দুঃখজনক মৃত্যু হয়। তবে চতুর রিয়াজ এই সুযোগকে কাজে লাগাতে উঠে পড়ে। বোমা হামলার পর সে শেখ সেলিমের মেয়ে ও তার মেয়ের জামাইকে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশ হাউজে নিয়ে তুলে। দফায় দফায় শেখ হাসিনার সাথে কথা বলে এবং ঘটনার আপডেট দেয়। বিষয়টি হৃদয় বিদারক হলেও এর মাধ্যমেই রিয়াজ শেখ সেলিম এবং শেখ হাসিনার সবচেয়ে আস্থাভাজন হয়ে উঠে। এর পরে শেখ হাসিনার বিভিন্ন বিদেশ ট্যুরে তাকে নিয়ে যেতো।  

সাম্প্রতিক সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘিরে যে সকল সংবাদ বের হয়েছে তার পিছনে রিয়াজ হামিদুল্লাহ এবং উপরোল্লোখিত কয়েকজনের সরাসরি ইন্ধন রয়েছে বলে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন। তাছাড়া মোজাম্মেল হকের নিয়োগ বাতিল নিয়ে পররাষ্ট্র সচিবকে ঘিরে যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে তাও সঠিক নয় বলে জানা গেছে। সঠিক হচ্ছে রিয়াজ হামিদুল্লাহর নেতৃত্বে সচিব নজরুল ইসলাম পিএইচডি ও আরো কয়েকজন প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করে। এরপর তারা পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে মোজাম্মেলকে একান্ত সচিব দিলে, এটি ভাল হবে না। 

বর্তমানে রিয়াজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশের নেপথ্যে রয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। এই বিষয়ে রিয়াজকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে সম্প্রতি ভারতে পদায়িত আবদুল্লাহ আল মামুন ও তার স্ত্রী সামিয়া ইশরাত রনি। বর্তমান সচিব জসীমকে সরিয়ে রিয়াজ হামিদুল্লাহ নিজেই পররাষ্ট্র সচিব হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে গোপন সূত্রে জানা যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অফিসারদের টার্গেট করে তাদের জড়িয়ে কাল্পনিক নোংরা স্ক্যান্ডাল তৈরী করে প্রায় সময়েই “উড়োচিঠি ডিপ্লোমেসি”র মূল অভিযোগ রিয়াজ হামিদুল্লার দিকে। ৫ই আগস্টের পর সাবেক সচিব মাসুদ বিন মোমেন তাকে নেদারল্যান্ড থেকে তাড়াহুড়ো করে দেশে নিয়ে আসে পররাষ্ট্র সচিব করার আশ্বাস দিয়ে। কিন্তু ভিতরের ও বাইরের প্রবল আপত্তির মুখে সেটা সম্ভব হয় নাই।

এবার তার এই নোংরা ক্যাম্পেইনের পন্থা অবলম্বন। রিয়াজসহ ১৫ ব্যাচের সুবিধাভোগী এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি তুলেছেন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ।