দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ


ডিসেম্বর ৩, ২০২৪। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ন সুক-ইয়লের নেওয়া পদক্ষেপটিকে এককথায় বলা যায় গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা। রাতের মধ্যপ্রহরে এক টেলিভিশন ঘোষণায় তিনি জরুরি সামরিক আইন জারি করেন। সবরকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের পাশাপাশি হরণ করেন বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সেনা প্রধানের প্রতি নির্দেশ জারি করেন বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় সংসদ বন্ধ করে দিতে। পুলিশ এবং বিশেষ বাহিনী প্রেরণ করেন সেখানে প্রবেশ ঠেকাতে। নিজের গৃহীত পদক্ষেপের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে ইয়ন বলেন, গণতন্ত্র রাক্ষার্থে এই পদক্ষেপের কোনো বিকল্প ছিল না।
দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ মানুষ, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার তার এই প্রচেষ্টাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। প্রতিবাদে লাখো মানুষ ছুটে যান সংসদ ভবনের চারপাশে। সেই দৌড়ে সামিল ছিলেন আইন প্রণেতারাও। সেখানে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ঘেরাও করে রাখেন এবং রাতের শেষ প্রহরে সংসদ প্রেসিডেন্টের আদেশ প্রত্যাহারের পক্ষে তাদের রায় প্রদান করেন। বিধি মোতাবেক এই ক্ষমতা সংসদের আছে যে কারণে ইয়ন তাদের সংসদে প্রবেশ আটকাতে চেয়েছিলেন প্রথমবারেই। পরবর্তী দুই সপ্তাহ ব্যাপক বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদের পাশাপাশি জনমত জরিপও বলছিল ৭৫ শতাংশ কোরিয়ান তাকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাইছে না। সংসদে তাকে অপসারণের পক্ষে ২০৪-৮৫ ভোটে প্রস্তাব পাশ হয়। তাকে তার দায়িত্ব পালন থেকে বিরত করা হয়। তার ফিরে আসা না আসার বিষয়টি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সাংবিধানিক আদালতের উপর। এর বাইরেও তিনি মোকাবেলা করছিলেন আরো কিছু আইনগত জটিলতা। শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি কোরিয়ার ইতিহাসের ক্ষমতাসীন প্রথম রাষ্ট্রপতি যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে
গত দু’মাসের ঘটনাগুলো বলছে দক্ষিণ কোরিয়ায় গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার আকাক্সক্ষার কথা। যা দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর আশির দশকের শেষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনা কোরিয়ানদের বহু বছর ধরে নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টিও সামনে আনলো। ৩ ডিসেম্বর রাতের ঘটনা বলছে দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র এখনো ভঙ্গুর। ইয়ন যে ক্ষতি করেছেন সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে দক্ষিণ কোরিয়ার অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তার নিজ দল রক্ষণশীল পিপলস পাওয়ার পার্টি (পিপিপি) এখনো তাকে সমর্থন করছে এবং দেশ জুড়ে চরমপন্থা ছড়িয়ে দিতে চাইছে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের পক্ষে আনতে গিয়ে ভুগছে, নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য নিয়েও সমস্যায় আছে। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় সমস্ত সমাধানের দায়িত্ব চাপছে কোরিয়ার সাধারণ নাগরিকদের ওপর। সেটা করতে হলে তাদেরকে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে হবে, প্রজন্মের মধ্যকার ব্যবধান কমাতে হবে। এবং প্লাবনের মত ছড়িয়ে পড়া অপতথ্যের মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি কেবল যুদ্ধ অথবা ভয়াবহ জনদুর্ভোগকর পরিস্থিতিতে সামরিক আইন জারি করতে পারেন। কিন্তু ইয়ন যখন সামরিক আইন জারির ঘোষণা নিয়ে টেলিভিশনে উপস্থিত তখন সে রকম কোন পরিস্থিতি ছিল না। তিনি কেবল ভিত্তিহীন সেই পুরোনো অভিযোগের কথাই উল্লেখ করেন অর্থাৎ উত্তর কোরিয়ার কমিউনিষ্ট আগ্রাসনের কথা। জনগণের প্রতি তার আহ্বান ছিল পিয়ংইয়ংপন্থী দেশবিরোধী শক্তিকে উৎখাত করে দেশের জনগণের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং সংবিধান সুরক্ষিত রাখার।
অনেক দক্ষিণ কোরিয়ানই উত্তর কোরিয়ার জুজুতে বিশ্বাস করেন। প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে সেইসব চরম দক্ষিণপন্থীদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন, যারা বিশ্বাস করেন উত্তর কোরিয়া তাদের দেশের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়ন তাদের সেই ধারণাকে ভিত্তি দিতে সামরিক আইন জারির পর পরই নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করতে পাঠান। এই ধারণাটি মূলত পুরাতনপন্থীদের যারা প্রভাবিত হন দক্ষিণপন্থীদের প্রচারিত ইউটিউব ভিডিয়োতে। তারা মূলধারার সাংবাদিকতা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতকে অবজ্ঞা করেন, সেইসব রক্ষণশীলদের তারা অবজ্ঞার চোখে দেখেন যারা ইয়নের নিন্দা করেছেন। চরম দক্ষিণপন্থীরা এখন কেবল ব্যক্তি ইয়নের রাজনৈতিক শক্তির জায়গা নয়। মূল দলেও তাদের বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে। যে কারণে পিপিপি দলীয় চরমপন্থীদের সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যা অন্যান্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রক্ষণশীন দলগুলোর মধ্যে দেখ যায়। ঠিক সে কারণে তারা ইয়নকেই সমর্থন করে গেছেন। এমনকি দলের যে সমস্ত নেতা ইয়নকে অপসারণের পক্ষে ছিলেন ১৬ ডিসেম্বর তাদের সরিয়ে দিয়েছে ইয়নপন্থীরা। হঠাৎ করেই রক্ষণশীল আইনপ্রণেতাদের মধ্য থেকে যারা ইয়নকে অপসারণের পক্ষে ছিলেন তারা নিজেদের মূল ধারার বাইরে ব্রাত্য মনে করছেন। ইয়নের ভক্তরা দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা হাতে তার বাসভবনের সামনে জড়ো হয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া শুরু করে।
দলের এই ধরনের কার্যক্রম এবং কোনো না কোনোভাবে ইয়নকে রক্ষা করতে চাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে একটি নতুন সংকটের সৃষ্টি করেছে। ইয়নের পরে যারা দায়িত্ব নিয়েছেন তারা বিভিন্নভাবে ইয়নকে রক্ষা করতে চাইছেন। এমনকি প্রয়োজনে তারা সাংবিধানিক আদালতের নির্দেশকেও নানা কৌশলে অমান্য করছেন। ইয়নের বিরুদ্ধে তারপরও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের তদন্ত চলছে। পাশাপাশি তার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তও চলছে। কিন্তু ইয়ন এই তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করতে যা কিছু করা সম্ভব তার সবই করছেন এবং সমর্থকদের আহ্বান জানিয়েছেন শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার জন্য। যে কারণে জানুয়ারির ৩ তারিখে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৫ তারিখে তদন্তকারী দলটি আরও অনেক বেশি শক্তি প্রয়োগ করে তাকে গ্রেফতার করে। ইয়ন অনেকটা অনুগ্রহ করে সাংবিধানিক আদালতে তার ইমপিচমেন্টের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরলেও দুর্নীতি বিষয়ক কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন।
বর্তমান অচলঅবস্থাÑ সামনে আরো খারাপ পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে। একদিকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ার, আবার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। এর প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও দেখা যেতে পারে। কোরিয়ান মুদ্রার মান নেমে গেছে, শেয়ার মার্কেটের অবস্থা ভয়াবহ। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি নতুন মার্কিন নীতি কি হবে সেটিও দেখার বিষয়। আবার চীনের সঙ্গে নতুন করে শুরু হওয়া বাণিজ্য যুদ্ধও দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার সঙ্গে নতুন সামরিক চুক্তি করেছে, তাদের সৈন্যরা রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেণে বাস্তব যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। আর এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় বিরাজ করছে নেতৃত্ব শুন্যতা।
এই পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক আদালত যদি ইয়নের ইমপিচমেন্টকে বৈধতা দেয় সেক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়াকে আবার নির্বাচনের পথেই ফিরে যেতে হবে। এই নির্বাচন হবে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে। আর এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলের নেতৃত্বের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা আছে অনেক আগে থেকেই। তবে এটা সুখকর যে, দক্ষিণ কোরিয়ার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ কোনো একক ব্যক্তির হাতে নেই। এমনকি সেটা পরবর্তী রাষ্ট্রপতির হাতেও নেই। ডিসেম্বরের ৩ তারিখের ঘটনাবলি সে কথাই বলছে। সংকটের মুহূর্তে সাধারণ মানুষ নেমে এসেছিল। এটা ঠিক ইয়নের অপসারণে আইন প্রণেতারা ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তাদের সেই সুযোগ তৈরি করে দিতে সেনাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল সাধারণ মানুষ। সাংবাদিকরাও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রতিবেদন লিখে গেছেন। এমনকি ইয়নকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ এবং সেনা কর্মকর্তারাও ইয়নকে রক্ষায় ততটা আগ্রহ দেখাননি। সাধারণ মানুষের ওপর বলপ্রয়োগে অস্বীকার করেছেন।
এই মুহূর্তে কোরিয়ায় গণতন্ত্র সংহত করতে হলে নাগরিক সমাজকে শক্তিশালী করতে হবে। রাজনৈতিক ভাষ্যকার এরিক মোব্র্যাডের মতে, প্রতিষ্ঠানগুলেকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে সেখানে। তিনি আরো বলেন দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাস বলে, অভিজাতেরা সংকটের পর যে কোনোভাবেই হোক ফলাফল তাদের পক্ষে নিয়ে যায়, জনগণের চাওয়া হয়ে পড়ে গুরুত্বহীন। এখন সময় এসেছে সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য আারো বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের। সেটি নির্বচনী ব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল সবাইকেই নতুন করে ভাবতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ মানুষ কিন্তু তৈরি, অতীতের মতো এবারেও তারা প্রমাণ করেছে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের নিবেদন ও আকাক্সক্ষার কথা।
জনগণের এই আকাঙক্ষা বাস্তবায়নে সাংবাদিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে আরো বেশি দায়িত্বশীলতার সাথে। অনলাইনে প্রচারিত ব্যাপক অপতথ্যের মোকাবিলায় প্রকৃত তথ্য পৌঁছে দিতে হবে জনগণের কাছে। শিক্ষাবিদদের নিতে হবে কার্যকর ভূমিকা, প্রকৃত সমস্যা ও তার সমাধানের পথ তুলে ধরতে হবে নতুন প্রজন্মের সামনে। সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, ইউটিউবে প্রচারিত বিভিন্ন ভ্রান্তিকর তথ্যের বিপরীতে তুলে ধরতে হবে সত্য। দেশে রাজনৈতিক বিভাজন দূর করতে এখনো অনেক কাজ বাকি। দূরত্ব ঘোচাতে হবে নবীন এবং প্রবীণের। কমাতে হবে নারী পূরুষের বৈষম্য। পরবর্তী সরকারে যেই আসুক তাকেও এগিয়ে নিতে হবে এই কাজগুলো। দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৪৮ সালে মার্কিন দখলদারিত্বের অধীনে রচিত সংবিধানের বিষয়েও নতুন করে ভাবতে হবে।
এই কাজগুলোর কোনোটাই খুব সহজ হবে তা নয়। সেই রাতে ইয়নের সামরিক আইন জারির ঘোষণাকে নিছক একটি ঘটনা ধরে নিলেও দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রকে পাড়ি দিতে হবে বিপৎসঙ্কুল পথ। আশার কথা হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকেরা এখন তৈরি। আগেও তারা স্বৈরশাসকের মোকাবিলা করেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা ধারণ করে দেশকে তারা সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যাবে।