ডোনাল্ড ট্রাম্প: ক্ষমতা ও অপরাধের দায়মুক্তি

শপথ গ্রহণের পর, সোমবার কলমের এক খোঁচায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৬ জানুয়ারি ২০২১ সালে ক্যাপিটালে হামলাকারী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, বিচার এবং শাস্তি দেওয়ার জন্য বিচার বিভাগের চার বছরের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করেছেন। যেটা ছিল আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধমূলক তদন্ত। তাদের বিরুদ্ধে, যারা ২০২১ সালে ট্রাম্পের ওয়াশিংটনে আসার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল এবং কংগ্রেসকে ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যয়ন করা থেকে বিরত করার চেষ্টা করেছিল। সে ঘটনায় সাত ঘন্টার অবরোধে ১৪০ জনেরও বেশি পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মৃত্যুর কারণ হয় ৪ জন ট্রাম্প সমর্থক এবং ৫ পুলিশ কর্মকর্তার।
এবার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার দিনই ট্রাম্প, ৬ জানুয়ারি দাঙ্গায় দোষী সাব্যস্ত প্রায় প্রত্যেককে ক্ষমা করেছেন। তার নির্দেশে বিচার বিভাগও ওয়াশিংটন ডিসির ফেডারেল আদালতকে ট্রাম্পের ভাষায় পক্ষপাতমূলক বিচারাধীন মামলাগুলো খারিজ করতে বলেছে। পরবর্তী সময়েও এ নিয়ে আর কোনো অভিযোগ তোলা যাবে না।
ওভাল অফিসে ট্রাম্প স্বাক্ষরিত প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় বলা হয়, গণক্ষমার এই পদক্ষেপ, ‘আমেরিকান জনগণের উপর সংঘটিত একটি গুরুতর জাতীয় অবিচারের অবসান ঘটায়।’ ট্রাম্পের এই ক্ষমা ঘোষণা সহিংস আক্রমণকারী আর অহিংস প্রতিবাদকারীদের মধ্যে কোন ভেদ রেখা রাখেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় এই ক্ষমার আওতায় রয়েছেন ডিসি’র পুলিশ অফিসার মাইকেল ফ্যানোনকে মারধরকারী এবং ইউএস ক্যাপিটল পুলিশ অফিসার ব্রায়ান সিকনিককে মরিচ স্প্রে করা ব্যক্তিও। যে ঘটনায় পরের দিন মারা যান সিকনিক।
‘সেদিন ৬ জন ব্যক্তি আমাকে নির্মমভাবে প্রহার করেছিল তারাও এই ঘোষণায় মুক্তি পাবে।’ এভাবেই বলছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা ফ্যানোন। তিনি আরো বলেন ‘তারা আমার জীবনের জন্য হুমকি হয়ে এসেছিল, হুমকির মুখে ফেলেছিল আমার পরিবারকে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ঘোষণায় আমি এবং আমার পরিবার এখন আরো বেশি অনিরাপদ’।
ট্রাম্প স্বাক্ষরিত ঘোষণায়, ৬ জানুয়ারি সংঘটিত অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রত্যেকেকে ‘সম্পূর্ণ এবং নিঃশর্ত ক্ষমা’র কথা বলা হয়েছে। যে ক্ষমার আওতায় রয়েছে আনুমানিক ১২৫০ জন। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং বেশিরভাগই আদালতে স্বীকার করেছেন যে, তারা আইন ভঙ্গ করেছেন। এই ঘোষণার ক্ষেত্রে সহিংস অপরাধ সংগঠন আর সাধারণ অপকর্মের মধ্যকার সীমারেখাও বিবেচনা করা হয়নি। অবশ্য এটা প্রত্যাশিত ছিল। ট্রাম্প এবং তার মিত্ররা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এমন ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন। এই ক্ষমার চাদরের আওতায় এমন অন্তত শতাধিক মানুষ রয়েছেন যারা পুলিশ অফিসারদের মারধর, গণমাধ্যমকর্মীদের উপর আক্রমণ, দায়িত্বশীলদের সরকারি কর্মে বাধা প্রদান এবং সরকারী সম্পত্তি ধ্বংস করেছেন।
বিস্ময়কর হলেও, এনরিক টাররিওর মতো লোকেরাও ক্ষমা পেয়ে যাচ্ছেন, যিনি ফার-রাইট প্রাউড বয়েজ দলের নেতা, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে যাকে ২২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। ক্ষমাপ্রাপ্তদের মধ্যে আরো রয়েছেন- ডেভলিন থম্পসন, যিনি একজন পুলিশ অফিসারকে ধাতব লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিলেন, আছেন ফ্লোরিডার রবার্ট পালমার, যিনি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, কাঠের খুঁটি নিয়ে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
ট্রাম্পের ঘোষণায় চরম দক্ষিণপন্থী দল প্রাউড বয়েজ এবং ওথ কিপারস এর ১৪ জন সদস্য রয়েছেন। যাদের জন্য ক্ষমার পরিবর্তে ভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা কারাগার থেকে মুক্তি পাবে ঠিকই কিন্তু বন্দুক রাখা অথবা ভোটাধিকারের মতো বিষয় থেকে বিরত থাকবেন। যা পাওয়া যায় সম্পূর্ণ ক্ষমায়। যদিও ট্রাম্প বলেছেন, তার প্রশাসন মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখবে ভবিষ্যতে তারা পূর্ণ ক্ষমা পাওয়ার অধিকারী কিনা।
এই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রের মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছিলÑ যাদের বেশিরভাগই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি তাদেরও বিভিন্ন অপরাধে সাজা হয়েছিল।
রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের জন্য এই ক্ষমা চমক জাগানিয়া। এই ধরনের অপরাধীদের ঘৃণ্যতম অপরাধী হিসেবে দেখা হয়। প্রসিকিউশন এটি প্রমাণ করেছিলেন যে, সেই দিনের দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারীদের থেকে এই মানুষগুলো ছিল আলাদা। তারা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।
কম্যুটেশনের আওতায় আছেন ওথ কিপারসের সহযোগী থমাস ক্যাল্ডওয়েল, যিনি রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেও ৬ জানুয়ারি দাঙ্গায় ব্যবহার ও মিত্রদের সরবরাহের জন্য নিকটবর্তী ভার্জিনিয়া হোটেলে অস্ত্র জমা করেছিলেন এবং বিচারকার্যে বাধা প্রদান করেন। ওথ কিপারস দলের ফ্লোরিডার নেতা কেলি মেগসকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। চরম দক্ষিণপন্থী প্রাউড বয়েজদের নেতা জোসেফ বিগসও মুক্তি পাবেন। যিনি এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা ষড়যন্ত্রের অন্যতম সংগঠক এবং সেদিন রাজধানীতে মবের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৬ জানুয়ারির ঘটনা সম্পর্কিত বেশিরভাগ মামলা ইতোমধ্যেই আদালতে সমাধান করা হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প শুধু সাজাপ্রাপ্তদেরই ক্ষমা করেননি আদালতে বিচারের অপেক্ষায় থাকা প্রায় ৩০০টি মামলা সরাসরি বাতিল করে দিয়েছেন। বিচার বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, এই মামলাগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ পুলিশের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণের অভিযোগ যার কিছু মামলার তদন্ত শুরু হয়েছিল সাম্প্রতিক সময়ে।
ঘোষণা অনুসারে, এ মামলাগুলো পক্ষপাতদুষ্ট বলে বাতিল করা হবে। অর্থাৎ ৬ জানুয়ারির ঘটনায় ভবিষ্যতে এদের কারো বিরুদ্ধে আর কোন অভিযোগও করা যাবে না।
ফেডারেল প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এই মামলাগুলো খারিজ করার জন্য আদালতে আবেদন করতে কয়েকদিন বা সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে মামলাগুলো বাতিল ঘোষণা করবেন আদালত কিন্তু এক্ষেত্রে জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের চওয়ার বাইরে আদালতে বিচারকের করণীয় খুব কম। স্বাভাবিক অবস্থায়, এ ধরনের অপরাধীদের ক্ষেত্রে বিচার সমাপ্ত না করে ছেড়ে দেওয়াটা বিপজ্জনক। কিন্তু মামলাগুলো খারিজ হয়ে গেলে তারাও মুক্তি পাবে।
২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় এবং তারপরেও ট্রাম্প এই ঘটনায় অভিযুক্তদের ক্ষমার কথা বলে আসছেন। যদিও ট্রাম্পের মিত্ররা কেবল সরাসরি সহিংসতায় জড়িত নয় এমন ব্যক্তিরাই ক্ষমার আওতায় আসবেন বলে বলছিলেন।
ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এই মাসেও বলেছেন, ‘সেদিনের ঘটনায় যারা সরাসরি সহিংসতায় জড়িত ছিলেন তাদের ক্ষমা করা উচিত নয়’। হাউস স্পিকার মাইক জনসন ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের আগের দিনও বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদকারীদের ক্ষমা করা উচিত, কিন্তু সহিংস অপরাধীদের ক্ষমা করার সুযোগ নেই।’ এমনকি ট্রাম্পের উপদেষ্টা জেসন মিলারও একই সুরে কথা বলেছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্য পরিষ্কারÑ ‘আমরা প্রতিটি মামলা আলাদাভাবে বিবেচনা করবো।’ মিলার বলেন ‘আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কোনো ধরনের সহিংসতা সমর্থন করি না। কিন্তু এটাও বলতে চাই সেই ঘটনায় অনেকের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। কাজেই প্রতিটি মামলাকে আমরা আলাদা আলাদা ভিত্তিতে যাচাইবাছাই করবো।’ কিন্তু মিলারের সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। হরেদরে সব এক চোখেই দেখা হয়েছে। ট্রাম্প সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যবহার করেছেন। চলমান মামলাগুলো পর্যন্ত খারিজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। ৯৮ শতাংশ দোষী সাবস্ত্যদের মুক্তির আদেশ দিয়েছেন। তিনি তার কট্টর সমর্থকদের সবার জন্যই ক্ষমা ঘোষণা করেছেন।
এ মামলাগুলোর সঙ্গে জড়িত একজন ফেডারেল অফিসার বলেন, ‘আমরা হতাশ কিন্তু বিস্মিত নই’ এবং ‘অপাতত চুপসে গেছি কিন্তু পরাজিত নই’। তারা বিশ্বাস করেন, ট্রাম্পের এই ক্ষমা দেশ এবং বিশ্বের কাছে একটি বার্তা। অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে হবে। এই ক্ষমার ধরন বলে যে, যদি তুমি জিতে যাও তবে এই ধরনের সহিংসতাও গ্রহণযোগ্য।
ক্ষমা ঘোষণার দিন থেকে, তিনি আগের মতোই ক্ষমার যথার্থতা প্রমাণ করতে ক্রমাগতভাবে মিথ্যা তথ্য এবং ভুল দাবি উপস্থাপন করে চলেছেন। প্রকৃত ইতিহাস পাল্টে দিয়ে তিনি ইতিহাসের নতুন বয়ান তৈরি করতে চেয়েছেন। এমনকি তিনি এটাও বলেছেন যে, এই মবে বহিরাগতদের আনা হয়েছিল এবং সহিংসতায় ইন্ধন জুগিয়েছে এফবিআই। এই তত্ত্ব প্রথম প্রচার করে চরম দক্ষিণপন্থীরা, ফার-রাইট সার্কেলে ২০২১ সালে। ট্রাম্প বিষয়টি লুফে নেন। এবং ক্রমাগতভাবে মিডিয়ার সামনে, জনসভায় বিষয়টি তুলে ধরতে থাকেন।
এটা সত্য যে সেই সমাবেশে এফবিআই এর পক্ষে কিছু তথ্যদাতা সেখানে ছিলেন কিন্তু এফবিআই এর নিজস্ব কোনো এজেন্ট ছিল না। তথ্যদাতারা ঘটনা উসকে দেওয়ার বা আইন ভাঙ্গার অনুমতিও পাননি। এটিও পরিষ্কার যে ট্রাম্প সমর্থকদের উসকে দিতে তথাকথিত ডিপ স্টেট এর কোনো ভূমিকা ছিল না। এটাও বলা হচ্ছে যে ক্ষমা ঘোষণার পরপরই ৬ জানুয়ারির ঘটনায় অভিযুক্তরা সাধারণ মুক্তি অথবা প্রবেশন পেতে যাচ্ছেন। ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরের আগে অভিষেক প্যারেডে ট্রাম্প ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হাতে বন্দি ইসরাইলিদের স্বজনকে উপস্থাপন করেন। তারপরই ৬ জানুয়ারির ঘটনায় বন্দিদের মুক্তির বিষয়টি টেনে আনেন। তিনি আদালতে প্রমাণিত এবং বিচারক কর্তৃক দণ্ডিত অপরাধীদের বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন অন্যমাত্রায়। যদিও তিনি ঘটনার পর পর বলেছিলেন, ‘আমি হতভম্ভ এবং গভীরভাবে ব্যথিত এই ঘটনায়।’ তখন তিনি নিজ দলেও একা হয়ে পড়েছিলেন এবং রীতিমত বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘এই দাঙ্গাকারীরা মার্কিন গণতন্ত্রকে অপবিত্র করেছে। যারা আইন ভেঙ্গেছে তাদের মূল্য দিতে হবে এবং বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’ তার সেই প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি এখন অনেক দূরে। সাংবিধানিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তিনি সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতেই পারেন। কিন্তু নৈতিকতার জায়গা থেকে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে ক্ষমতা এ ধরনের দায়মুক্তি প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থায় চিড় ধরাবে কি না। এটি যে একেবারে নতুন তাও নয় আর সারা বিশ্বেই এ ধরনের ক্ষমা-দায়মুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মজার বিষয় হলো, পূর্বসূরী জো বাইডেনের করে যাওয়া ঢালাও আগাম ক্ষমা নিয়ে ট্রাম্প বলেছেন,‘তিনি নিজেকে ক্ষমা না করে গিয়ে ভুল করেছেন’। ইঙ্গিতবহ বটে।
লেখক: ডেপুটি এডিটর, দৈনিক সংবাদ প্রবাহ