পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুবিধাবাদী জুটি

বাংলাদেশের কূটনৈতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান ও তার স্বামী মো. নজরুল ইসলাম বহুল আলোচিত দম্পতি, যারা ক্ষমতার আশ্রয়ে থেকে একের পর এক পদোন্নতি আদায় করেছেন এবং সর্বশেষ স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত অনুগত হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ক্ষমতার সুবিধা নেওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অবস্থান বদলেছেন এবং যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন সেই দলের বিশ্বস্ত অনুগত হওয়ার অভিনয় করেছেন। সেই ধারা বজায় রেখে ৫ই আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরেও তিরস্কৃত হবার পরিবর্তে তারা হয়েছেন সর্বোচ্চ পুরস্কৃত। অনেক যোগ্য অফিসারকে পেছনে ফেলে দুজনেই পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সচিব এবং বাগিয়ে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ দুটি মিশনে রাস্ট্রদূতের পদ। নাহিদা শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক নিয়োজিত হয়েও এখনো বহাল তবিয়তে কানাডায় ও নজরুল কাতার থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাচ্ছেন শিগগিরই ।

নাহিদা সোবহান ছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের একজন সক্রিয় সহযোগী। দীর্ঘ ৯ বছর জেনেভায় অবস্থান করে হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন ও রাজনৈতিক নির্যাতনকে আড়াল করতে আন্তর্জাতিক মহলে লবিং করেছেন। তার স্বামী মো. নজরুল ইসলামও ছিলেন সমান সুবিধাবাদী। যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছেন।

নজরুলের মাহবুবুল হক শাকিলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও ছাত্রজীবনের সম্পর্ক:

নজরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের ছাত্র, যিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পটু ছিলেন। তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ হাসিনার এককালের বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল। নজরুল ও শাকিল একই হলে রুমমেট ছিলেন, আর এই সম্পর্কের ভিত্তিতেই তিনি আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত পৌঁছান।

শাকিল আওয়ামী লীগের ভেতরে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন এবং শেখ হাসিনার অত্যন্ত কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল, তিনি শাকিলের ব্যক্তিগত বন্ধু হওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভেতরে তার ব্যাপক প্রভাব ছিল। এই প্রভাবের জোরেই তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের অবস্থান সুসংহত করেন এবং একের পর এক সুযোগ লাভ করেন।

নজরুলের রাজনৈতিক রঙ বদলানোর অতুলনীয় ক্ষমতা:

নজরুল ইসলাম বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার থাকাকালে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর (সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোটো ছেলে) ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি প্রায়শই গর্ব করে বলতেন যে, তিনি কোকোর বন্ধু এবং বিএনপির অভ্যন্তরীণ মহলে তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

এমনকি, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তিনি জামায়াতে ইসলামী নেতাদের সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করতেন এবং নিজেকে জামায়াতপন্থী পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করতেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তিনি নিজেকে ইসলামী রাজনীতির ঘনিষ্ঠ হিসেবে উপস্থাপন করতেন এবং জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা প্রচার করতেন।

কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি দ্রুত নিজের অবস্থান বদলে ফেলেন। তখন তিনি মাহবুবুল হক শাকিলের ঘনিষ্ঠতা ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত অনুগত হওয়ার চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে তিনি দাবি করতে থাকেন যে, তিনি বরাবরই আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করেছেন এবং তার রাজনৈতিক আনুগত্য শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের প্রতি।

ক্ষমতার ছায়ায় নাহিদা-নজরুল:

নাহিদা সোবহান ও নজরুল ইসলাম নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এতটাই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন যে, তারা দুজনেই দীর্ঘ ৯ বছর একসঙ্গে জেনেভায় দায়িত্ব পালন করেন, যা সাধারণত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ম বহির্ভূত। অভিযোগ রয়েছে, তারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি থাকার জন্য যেকোনো ধরনের সুবিধাবাদী আচরণে লিপ্ত হয়েছেন।

নাহিদা সোবহান ছিলেন হাসিনা সরকারের অন্যতম ‘পছন্দের’ কূটনীতিক, যার কাজ ছিল সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনকে ন্যায্যতা দেওয়া। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তিনি হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। তাছাড়া তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানেরব ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন এমন দাবি করে হাসিনার নজরে আসা, নিজের নামের আগে শেখ জুড়ে দেয়া, প্রটোকলের সমস্ত নিয়ম নীতি ভেঙে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্লেনের গোড়ায় রিসিভ করতে বিনা অনুমতিতে জর্ডান থেকে ফুলের তোড়া নিয়ে কাতার চলে আসা, শুধু উপরে উঠার জন্য এমনসব শত শত বিতর্কিত ঘটনার জন্মদাত্রী এই কর্মকর্তা।

অন্যদিকে, নজরুল ইসলাম কাতারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে একইভাবে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কানাডায় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা ও রাজনৈতিক রঙ পরিবর্তন:

শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নাহিদা সোবহান দ্রুত কানাডায় চলে যান। কিন্তু কানাডায় আসার পর টিকে থাকার জন্য তিনি নতুন খেলায় মেতে ওঠেন। আওয়ামী লীগের অনুগত থাকার পাশাপাশি তিনি বিএনপির নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন।

অভিযোগ রয়েছে, কানাডা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তিনি গোপনে বৈঠক করেন এবং রাষ্ট্রীয় তহবিল খরচ করে বিএনপির কিছু নেতাকে খুশি করার চেষ্টা করেন।

টরন্টোয় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিএনপির নেতারা প্রথমে তার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানালেও, নজরুল ইসলামের মধ্যস্থতায় নাহিদা সোবহান শেষ পর্যন্ত বিএনপির নেতাদের জন্য গোপনে নৈশভোজের আয়োজন করেন। রাষ্ট্রীয় তহবিলের টাকা খরচ করে আয়োজিত ওই নৈশভোজের মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন সরকার গঠিত হলে তাঁর কানাডায় থাকা নিশ্চিত করা।

তবে এতকিছুর পরেও দায়িত্ব নেওয়ার ৬ মাসেও কানাডার বাংলাদেশী কমিউনিটি তাকে মেনে নেয়নি। কারণ কমিউনিটি অথবা দেশকে সার্ভিস দেয়ার পরিবর্তে নিজের অবস্থান মজবুত করতে উনি এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতেই ব্যস্ত।

নাহিদা সোবহান ও নজরুল ইসলামের এই কর্মকাণ্ড এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও ওপেন সিক্রেট। সবাই জানেন, তারা শুধুমাত্র সুবিধাবাদী, যারা ক্ষমতার স্বার্থে যেকোনো কিছু করতে পারে। উপদেষ্টা ও সচিবও তাদের এই নীতিহীনতার ব্যাপার পুরোপুরি অবগত কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে অনিচ্ছুক অথবা অপারগ।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, তাদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করা হচ্ছে এবং তদন্ত সাপেক্ষে সামনে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।

নাহিদা সোবহান ও নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের কূটনীতিতে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তারা বিএনপির ক্ষমতার সময়ে কোকোর বন্ধু সেজে সুবিধা নিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন, এরপর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পর হাসিনার বিশ্বস্ত হয়েছেন। আর এখন যখন হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের অবসান হয়েছে, তখন তারা আবার নতুন রাজনৈতিক ঘরানার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে বিগত সরকারের সুবিধাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আধিপত্য স্বভাবতই প্রশ্নের উদ্রেক করে কারণ একদিকে বিষয়টি যেমন দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যদিকে ৫ আগস্ট পরর্বতী সময়ে প্রশাসনে এই ধরনের সুবিধাবাদী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি।